
৪ঠা ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস
ক্যান্সার কথাটা শুনলেই প্রথমে যা মাথায় আসে তা হল সত্যিই কি আছে এই রোগের কোনো পাকাপোক্ত অ্যানসার। তবে হ্যাঁ ক্যানসার মানেই যে No Answer এমনটাও নয় বর্তমান যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত হওয়ার কারণে আগে যেমন এই ক্যান্সার নামটা শুনলেই সেই ব্যক্তি বা তার পরিবারে শোকের ছায়া ঘনিয়ে আসতো মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হতো এখন প্রথম ধাপেই যদি ক্যান্সার চিহ্নিত করা যায় তবে তা সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য এবং তার প্রমাণ ও আমাদের চোখের সামনেই আছে যেমন - ক্রিকেটের যুবরাজ সিং,বিখ্যাত অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা এঁরা সকলেই ক্যানসারকে জয় করে সুস্থ জীবনযাপন করছেন।
ক্যান্সার কি?
ক্যান্সার বা কর্কট রোগ বহুপ্রাচীন কাল থেকেই ছিল।এটি প্রায় 5,000 বছর আগে মিশরে প্রথম নথিভুক্ত হয়েছিল। সেই সময় থেকে, সারা বিশ্বের সংস্কৃতির লোকেরা এই রোগ এবং এর সম্ভাব্য চিকিত্সা সম্পর্কে লিখেছেন।ক্যান্সার এমন একটি রোগ যেখানে শরীরের কিছু কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ট্রিলিয়ন কোষ দ্বারা গঠিত মানব দেহের প্রায় যেকোনো জায়গায় ক্যান্সার শুরু হতে পারে। সাধারনত, মানুষের কোষ বৃদ্ধি পায় এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করে (কোষ বিভাজন নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে) শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন কোষ গঠন করে। যখন কোষগুলি পুরানো হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তারা মারা যায় এবং নতুন কোষ তাদের জায়গা নেয়।কখনও কখনও এই সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়াটি ভেঙ্গে যায় এবং অস্বাভাবিক বা ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলি বৃদ্ধি পায় এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। একেই টিউমার বলে। এই টিউমার বিনাইন বা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকেই ক্যান্সার বলে।
ক্যানসারের লক্ষণ :-
ক্যান্সার দ্বারা সৃষ্ট লক্ষণ এবং উপসর্গ শরীরের কোন অংশ প্রভাবিত হয়।কিছু সাধারণ লক্ষণ এবং উপসর্গ যা ক্যান্সারের সাথে যুক্ত কিন্তু নির্দিষ্ট নয়, এর মধ্যে রয়েছে:-
* ক্লান্তি
* পিণ্ড বা ঘন হয়ে যাওয়া অংশ যা ত্বকের নিচে অনুভূত হতে পারে।
* অস্বাভাবিক হ্রাস বা বৃদ্ধি সহ ওজন পরিবর্তন।
* ত্বকের পরিবর্তন, যেমন ত্বকের হলুদ হওয়া, কালো হওয়া বা লাল হয়ে যাওয়া, ঘা যা সহজে সেরে না ওঠা।
* টয়লেটে যাওয়ার সময় পরিবর্তন । মল বা প্রস্রাবের সাথে রক্ত ক্ষরণ ক্রমাগত পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, পায়ুপথে ব্যথা, আলগা, ফ্যাকাশে বা চর্বিযুক্ত মল, বা মল খালি হয়নি এমন অনুভূতি। প্রস্রাব করতে না পারা, ব্যথা হওয়া মূত্রাশয়ের অভ্যাসের পরিবর্তন।
*টয়লেটে যাওয়ার সময় রক্তের পাশাপাশি, ঋতুচক্রের বাইরের যোনিপথ থেকে, কাশির সময়, বমিতে, রক্তপাত হতে পারে।
*স্তনের আকার, আকৃতি বা অনুভূতির পরিবর্তন হয়, বা লালচে ব্যথা বা ত্বকের পরিবর্তন হতে পারে, যদি রক্তের দাগযুক্ত তরল সহ তরল, ফুটো হয়, বিশেষ করে যদি একজন মহিলা গর্ভবতী না হন বা বুকের দুধ খাওয়ান না, তবে এটি আরেকটি সতর্কতা চিহ্ন হতে পারে।
* ক্রমাগত কাশি বা শ্বাসকষ্ট।
*খাবার গিলতে অসুবিধা।
*খাওয়ার পরে অবিরাম বদহজম বা অস্বস্তি।
*অবিরাম, অব্যক্ত পেশী বা জয়েন্টে ব্যথা।
*অবিরাম, অব্যক্ত জ্বর বা রাতের ঘাম।
*ব্যাখ্যাতীত রক্তপাত বা ক্ষত।
ক্যান্সার কোথায় বাসা বাঁধতে পারে ?
প্রায় 200 বেশি ক্যানসারের ধরন আছে । মানুষের শরীরের যেকোনো অংশেই এই ক্যান্সার বাসা বাঁধতে পারে। যেমন -
মূত্রাশয় ক্যান্সার
মূত্রাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে রয়েছে ধূমপান, জেনেটিক মিউটেশন এবং কিছু রাসায়নিকের এক্সপোজার।
স্তন ক্যান্সার
বেশিরভাগ মহিলাদের এই স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ছে । তবে নিয়মিত ম্যামোগ্রাম হল সর্বোত্তম পরীক্ষা যা ডাক্তারদের প্রথম দিকে স্তন ক্যান্সার খুঁজে বের করতে হয়। কখন শুরু করতে হবে এবং কত ঘন ঘন স্ক্রীনিং ম্যামোগ্রাম করতে হবে সে সম্পর্কে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে।
সার্ভিকাল ক্যান্সার (জরায়ুর ক্যান্সার)
জরায়ুর ক্যান্সার হলো মহিলাদের মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। তবে স্ক্রীনিং পরীক্ষা এবং HPV ভ্যাকসিন সার্ভিকাল ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে।
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার (মলদ্বারে ক্যান্সার)
বয়সকালে এই রোগের সম্ভাবনা বেশি তবে এখন অল্পবয়সীদের মধ্যেও এই ক্যান্সার দেখা দিচ্ছে। স্ক্রীন করান, স্ক্রীনিং পরীক্ষা কোলোরেক্টাল ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে বা এটিকে প্রাথমিকভাবে খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারে, যখন চিকিত্সা সর্বোত্তম কাজ করে।
গাইনোকোলজিক ক্যান্সার
পাঁচটি প্রধান ধরনের ক্যান্সার একজন মহিলার প্রজনন অঙ্গকে প্রভাবিত করে: সার্ভিকাল, ডিম্বাশয়, জরায়ু, যোনি এবং ভালভার। একটি গ্রুপ হিসাবে, তাদের বলা হয় স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত ক্যান্সার।
মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সার
মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সারের মধ্যে রয়েছে মাথা ও গলার বিভিন্ন স্থানে শুরু হওয়া ক্যান্সার, মস্তিষ্কের ক্যান্সার।
লিভার ক্যান্সার
লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে, হেপাটাইটিস বি-এর বিরুদ্ধে টিকা নিন, হেপাটাইটিস সি-এর জন্য পরীক্ষা করুন এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করা এড়িয়ে চলুন।
কিডনি ক্যান্সার
কিডনি এবং রেনাল পেলভিস ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে, একটি স্বাস্থ্যকর ওজন রাখুন। ধূমপান করবেন না, বা যদি করেন তবে ছেড়ে দিন।
ওভারিয়ান ক্যান্সার
ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার মহিলাদের প্রজনন সিস্টেমের অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় বেশি মৃত্যুর কারণ। কিন্তু যখন ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়, তখন চিকিৎসা সবচেয়ে ভালো কাজ করে।
মূত্রথলির ক্যান্সার
বেশিরভাগ প্রোস্টেট ক্যান্সার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে না। আপনি প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য পরীক্ষা বা চিকিত্সা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও জানুন এবং আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
মেলোমা
শরীরে যেখানে কোনও কোষ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়, তাকে ক্যানসার বলে। রক্তের প্লাজমা কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বলা হয় মাল্টিপল মেলোমা.
ক্যান্সার চিকিৎসা পদ্ধতি
ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বায়োমার্কার টেস্টিং হল জিন, প্রোটিন এবং অন্যান্য পদার্থ (যাকে বায়োমার্কার বা টিউমার মার্কার বলা হয়) খোঁজার একটি উপায় যা ক্যান্সার সম্পর্কে তথ্য প্রদান করতে পারে। বায়োমার্কার পরীক্ষা আপনাকে এবং আপনার ডাক্তারকে ক্যান্সারের চিকিৎসা বেছে নিতে সাহায্য করতে পারে।
কেমোথেরাপি
কেমোথেরাপি হল এক ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসা যা ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলার জন্য ওষুধ ব্যবহার করে। ৫০টিরও বেশি ধরনের কেমিওথেরাপি ওষুধ রয়েছে। এগুলোর কোনকোনটা ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল হিসেবে খেতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ওষুধগুলোকে স্যালাইনের সাথে বা অন্য কোনভাবে সরাসরি রক্তে দিয়ে দেয়া হয়। রক্তের সাথে মিশে এই ওষুধগুলো শরীরের যেখানে যেখানে ক্যান্সার কোষ রয়েছে সেখানে গিয়ে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে।
হরমোন থেরাপি
হরমোন থেরাপি হল এমন একটি চিকিৎসা যা স্তন ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের বৃদ্ধিকে ধীর করে দেয় বা বন্ধ করে দেয় যা বৃদ্ধির জন্য হরমোন ব্যবহার করে।
হাইপারথার্মিয়া
হাইপারথার্মিয়া হল এমন এক ধরনের চিকিৎসা যেখানে শরীরের টিস্যুকে 113 °F পর্যন্ত উত্তপ্ত করা হয় যাতে স্বাভাবিক টিস্যুর সামান্য বা কোন ক্ষতি না করে ক্যান্সার কোষগুলির ক্ষতি এবং মেরে ফেলা হয়।
ইমিউনোথেরাপি
ইমিউনোথেরাপি হল এক ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসা যা আপনার ইমিউন সিস্টেমকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
বিকিরণ থেরাপির
রেডিয়েশন থেরাপি হল এক ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসা যা ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলা এবং টিউমারকে সঙ্কুচিত করতে উচ্চ মাত্রায় বিকিরণ ব্যবহার করে।
অস্ত্রপ্রচার
যখন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়, অস্ত্রোপচার হল একটি পদ্ধতি যেখানে একজন সার্জন আপনার শরীর থেকে ক্যান্সারের কোষ গুলো অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়
ক্যান্সার প্রতিরোধের প্রথম ও প্রধান উপায় হল নিজের মনে সাহস আনা ক্যান্সার হয়েছেই মানে আপনি বাঁচবেননা এমন ধারণা থেকে দূরে থাকা ।
১.নিয়মিত ব্যায়াম ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। নিয়মিত ব্যায়ামে শরীরের হরমোন প্রবাহ, কোষ বৃদ্ধির হার, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা থাকে স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে। সুতরাং প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শরীর চর্চার পেছনে সময় দিন।
২. সবসময় কম আঁচে খাবার রান্না করুন। গবেষকরা বলেন, যারা অতিরিক্ত ভাজা-পোড়া জাতীয় খাবারে অভ্যস্ত, ফাস্ট ফুড খেতে পছন্দ করেন তাদের বেশিরভাগেই অগ্ন্যাশয়, কোলোরেক্টাল ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
৩.ধূমপান,অ্যালকোহল পান বন্ধ করে দিতে হবে এর জন্যেই ফুসফুসে ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার হয়ে থাকে
৪.স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণের অভ্যাস করতে হবে। শরীরের নানা রোগের পেছনে খাদ্যাভ্যাসের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। অনিয়মিত খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর । প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসবজি ,জল ও মৌসুমি ফল খান।
৫.আমরা অনেকেই জানি না যে, সূর্যের আলো শরীরে ভিটামিন D সঞ্চার করে ও মেলানিনের সৃষ্টি হয়, এই মেলানিন ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলতে সাহায্য করে।
৬.নিরাপদ যৌনতা অনুশীলন করুন। যৌন সঙ্গীর সংখ্যা সীমিত করুন এবং একটি কনডম ব্যবহার করুন। সারাজীবনে যৌন সঙ্গীর সংখ্যা যত বেশি হবে, সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশন যেমন HIV বা HPV হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।যাদের এইচআইভি বা এইডস আছে তাদের মলদ্বার, লিভার এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি। HPV প্রায়শই সার্ভিকাল ক্যান্সারের সাথে যুক্ত, তবে এটি মলদ্বার, লিঙ্গ, গলা, ভালভা এবং যোনিতে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
নীচে আপনাদের জন্য কলকাতার কয়েকজন বিশিষ্ট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ (oncologist) ডাক্তারদের এবং হসপিটাল নামের লিস্ট দেওয়া হলো
MBBS(CAL), MD(RADIATION ONCOLOGY), MRCP(UK), MRCP(UK)MEDICAL ONCOLOGY, ESMO CERTIFICATE IN MEDICAL ONCOLOGY
Senior Medical Oncologist
Fortis Hospital, Anandapur, Kolkata
Phone. 033 6628 4444
MBBS.MD (Radio Therapy)
Bellevue clinic Kolkata
ফোন -+৯১৩৩৬৬৮৮৮৮৮৮
FRCS(EDIN), FRCS(ENG),FIAGES
Surgical Oncology
২৪ঘণ্টা হেল্পলাইন নম্বর- +৯১৯০০৭০৮৭২৭০ / ৯৮৩১২১৬৫৭৫
৪ঠা ফেব্রুয়ারি 2023 বিশ্ব ক্যান্সার দিবসে ফর্টিস হাসপাতাল গোষ্ঠী ক্যান্সার আক্রান্তদের জন্য সারা দেশ জুড়ে একটা হেল্পলাইন নম্বর চালু করলেন (৮৫৮৬০৯১০৫১) সোমবার থেকে শনিবার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চালু থাকবে।